কক্সবাজারের উখিয়ায় হিন্দু শরণার্থীর লাশ উদ্ধার, হত্যার অভিযোগ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে
ডিটেকটিভ নিউজ ডেস্ক
কক্সবাজারের উখিয়ায় এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ দুই সহোদর হিন্দু শরণার্থীর একজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। রবীন্দ্র পাল (৪২) নামে মিয়ানমার থেকে আগত এই ব্যক্তিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের গত শনিবার রাতে বলেন, পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী খাল থেকে সকালে রবীন্দ্র পালের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও মুখম-ল বিকৃত করা হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মধ্যে সহিংসতার মুখে সেখান থেকে এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কয়েকশ হিন্দুও পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের কাছেই একটি এলাকায় ওই সব হিন্দু শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কুতুপালং হিন্দু শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া নিখিল চন্দ্র পালের এই ছেলে রবীন্দ্র পাল ও নীরেন্দ্র পাল এক সপ্তাহ আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের শিবিরে ঢুকে। ওসি খায়ের বলেন, স্থানীয়দের কাছে খবর পেয়ে পুলিশ সকালে রবীন্দ্র পালের লাশ উদ্ধার করলেও পরিচয় নিশ্চিত হতে পারছিল না। পরে স্বজনরা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গিয়ে তার লাশ শনাক্ত করেন বলে পূজা উদযাপন পরিষদ উখিয়া উপজেলা কমিটির সভাপতি স্বপন শর্মা রনি জানান। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় আশ্রয় নেওয়া কতিপয় রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীর কাছে সেদেশে টাকা পাওনা ছিল রবীন্দ্র পালের। ওই টাকার জন্য এক সপ্তাহ আগে রবীন্দ্র পাল ও তার ভাই নীরেন্দ্র পালসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ১১ জন কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে যান। ওই টাকা নিয়ে কথার একপর্যায়ে দেনাদার রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীরা তাদের জিম্মি করে রাখে। এ সময় হিন্দু শরণার্থীদের মারধরসহ নানা নির্যাতন চালানো হয়। একপর্যায়ে কৌশলে নয়জন পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও রবীন্দ্র পাল ও তার ভাই নীরেন্দ্র পাল নিখোঁজ ছিল। রবীন্দ্র পালের লাশ পাওয়া গেলেও নীরেন্দ্রর বিষয়ে এখনও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মিয়ানমারে পাওনা টাকা নিয়ে মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থীরা রীবন্দ্র পালকে হত্যা করেছে অভিযোগ করে দায়ীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা। ওসি খায়ের বলছেন, পুলিশ এ বিষয়ে নানাভাবে খোঁজ খবর নিচ্ছে। ঘটনাটি তদন্তপূর্বক দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে, রাখাইন রাজ্যে হত্যা, লুটপাট, বাড়ি পোড়ানোর জন্য যখন রোহিঙ্গারা দুষছে করছে মিয়ানরমারের সেনাবাহিনীকে; তখন পালিয়ে আসা হিন্দু শরণার্থীরা তাদের উপর হামলার জন্য দায়ী করছে ‘রোহিঙ্গা জঙ্গিদের’। রাখাইনে সাম্প্রতিক সহিংসতার পালিয়ে আসা ৪ লাখ শরণার্থীদের মধ্যে শ’ পাঁচেক হিন্দু রয়েছেন, যারা বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারের বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যটির বাসিন্দা। গত ২৫ অগাস্ট রাখাইনে সেনা ও পুলিশ ফাঁড়িতে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)’র হামলার পর শুরু হয় সেনা অভিযান। তারপর শরণার্থীদের ঢল নামে বাংলাদেশ সীমান্তে। ওই অভিযানে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়ি পোড়ানো হয় বলে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা জানান। ওই শরণার্থীর মিছিলে যোগ দেন সহিংসতায় ঘর হারানো হিন্দুরা। হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের কাছে তাদের উপর হামলাকারীর পরিচয় জানতে চাইলে তারা সবাই ‘কালা পার্টি’র কথা বলেন। তাদের অন্তত ১০ জন বলেন, হামলকারীরা বার্মিজ, রাখাইন ভাষার পাশাপাশি রোহিঙ্গা ভাষায়ও কথা বলছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, বার্মিজরা সাধারণত রোহিঙ্গা ভাষা জানে না। কালো কাপড়ে মুখ বাঁধা থাকলেও তাদেরকে দেখে রোহিঙ্গাই মনে হয়েছে। হিন্দুদের মধ্যে এক তরুণকে পাওয়া গেল, যিনি কোররবানির ঈদের আগে জীবিকার প্রয়োজনে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সংঘাতের খবর পাওয়ার পর তার আর ফেরা হয়নি, বাংলাদেশে বসেই তিনি মা-বোন আর ভাতিজার মৃত্যুর খবর পান। পালিয়ে আসা নিজ সম্প্রদায়ের অন্যান্যের দেওয়া তথ্য তুলে ধরে এই তরুণ সরাসরিই বলেন, হিন্দুদের উপর হামলা চালিয়েছিল ‘রোহিঙ্গা জঙ্গিরা’। ওরা পোশাক পরেছে কালা, চোখ দুইটা দেখা যাচ্ছিল। একটা অস্ত্র, একটা বল্টু-এগুলো নিয়ে মারধর করেছে। কাডি ফেলছে। আক্রমণকারীরা রোহিঙ্গা এটা কীভাবে বোঝা গেল- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওনারা (প্রতিবেশী) বলছে, বাড়িতে কে কে হামলা দিছিল। ওনারা বলেছে, জঙ্গিরা আছিল, রোহিঙ্গারা আছিল। মংডুর সাববাজারে যে এলাকায় এই তরুণের বাড়ি, সেখানে রোহিঙ্গারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেশে ফিরতে ভীত এই হিন্দু তরুণ বলেন, আমার বাবা-মাকে কেটে ফেলছে, আমার ভয় লাগছে না? এত লোক পালিয়ে এসেছে এখানে, আমি একলা কীভাবে যাব? রোহিঙ্গারা তো চলে এসেছে- বলা হলে তিনি বলেন, সবাই চলে আসছে, না কি সেখানে (কেউ কেউ) থাকছে সেটা বুঝতে পারছি না। হিন্দু শরণার্থী শিবিরে থাকা রাখাইনের চিকনছড়ির এলাকার এক প্রৌঢ় বলেন, সেখানে (রাখাইনে) জঙ্গি পার্টি একটা ঢুকছে। সরকারের সাথে রোহিঙ্গা বলার দাবি আদায় করতে সন্ত্রাস ঢুকছে। এই সন্ত্রাসরাই আমাদেরকে নির্যাতন করতে আছে। তিনি বলেন, আমি বলেছিলাম, আমরা হচ্ছি অল্প সংখ্যক। আমরা হিন্দু। (নিজেদেরকে) রোহিঙ্গা বলতে পারব না। হামলার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, পাড়ার ৫০-৬০ জন মানুষকে সন্ত্রাসী-জঙ্গি পার্টিরা ৬-৭ দিন বন্দি করে রাখছে। পানিও খেতে পারব না। সাত দিন পর জঙ্গ শুরু হয়েছে, লড়াই বেঁধেছে, তখন আমরা রাস্তা পেয়েছি (পালানোর)। সামনে দিয়ে একটা খাল আছে, সেই খালে ঝাঁপ দিয়ে, নদীর মাঝে ঝাঁপ দিয়ে বনে ঢুকেছি। পাহাড়ে উঠে দেখি, আমাদের বাসা সব জ¦ালিয়ে দিয়েছে। এর আগে ১৯৯১ সালে শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন এই হিন্দু ব্যক্তি। তখনও রোহিঙ্গাদের একটি দল হামলা চালিয়েছিল বলে তার দাবি। বাংলাদেশে আগে থেকে ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের জঙ্গি তৎপরতাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার কথা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামে যে সংগঠনটি কয়েক বছর আগে গড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগের সন্দেহও করেন অনেকে। হামলার পর সেনা অভিযানের মুখে দলটি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়। মিয়ানমারে বালুখালী থেকে আসা এক হিন্দু বৃদ্ধ বলেন, দুই পক্ষের লড়াই যখন শুরু হয়, তখন তাদের (হিন্দুদের) অস্তিত্বের কথা কারোরই খেয়াল থাকে না।